নিজস্ব প্রতিবেদক ;
২০০৯ সালের ওই ঘটনায় প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের দরবার হল থেকে বিদ্রোহের সূচনা হয়। নানা ঘটন অঘটনের মধ্য দিয়ে পরদিন ঘটে এর অবসান।
পিলখানায় বিদ্রোহের সূত্র ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে জওয়ানরা বিদ্রোহ করে। সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর ওই বিদ্রোহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন তোলে।
রক্তাক্ত সেই বিদ্রোহের পর সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
পিলখানা হত্যা মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে হাই কোর্ট বলেছে, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা।
আদালত সেই রায়ে বলে, বিডিআরের জওয়ানরা ‘দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে’ যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, সেই কলঙ্কের চিহ্ন তাদের বহুকাল বহন করতে হবে।
দিনটি স্মরণে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সেনা সদর নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে শুক্রবার।
রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) সকালে বনানী সামরিক কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরসহ সকল রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটে কোরআন খতম, বিজিবির সকল মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে দোয়া ও মিলাদ হবে।
বিজিবির সকল স্থাপনায় এদিন বাহিনীর পতাকা অর্ধনমিত থাকবে, সদস্যরা কালো ব্যাজ পরবেন। বিজিবির সকল সেক্টর ও ব্যাটালিয়ন পর্যায়ে হবে বিশেষ দরবার।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদরদপ্তরে গুলির শব্দ পাওয়া যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভাবছিলেন, কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু কিছু সময় পর জানা যায়- বিদ্রোহ হয়েছে; পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা।
বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে পিলখানার চারদিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়।এদিকে পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে।
এক পর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মীর্জা আজম ও সাংসদ ফজলে নূর তাপস এ আলোচনার নেতৃত্ব দেন।
বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরে পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন।
গভীর রাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন।
কিন্তু এরপরও পিলখানা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের।
বিদ্রোহের প্রথম দিন দুপুরে কামরাঙ্গীরচর বেড়িবাঁধের কাছে ম্যানহোলের মুখে দুই বিডিআর কর্মকর্তার লাশ পাওয়া গেলে হৈ চৈ পড়ে যায়। বোঝা যায়, ভেতরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বিদ্রোহ অবসানের পরদিন পিলখানায় পাওয়া যায় একাধিক গণকবর। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ।
বিচার
বিডিআর বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুই ধরনের মামলা হয়। এর একটি বিদ্রোহের মামলা আর অন্যটি পিলখানায় হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরক আইনের মামলা।
পিলখানাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিডিআর আইনে ৫৭টি বিদ্রোহের মামলার বিচার শেষ হয় ২০১২ সালে। গত বছর হাই কোর্টে হত্যা মামলার আপিলের রায় এসেছে। তবে বিস্ফোরক আইনে করা মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি।
বিডিআর বিদ্রোহের ৫৭টি মামলায় ছয় হাজারেরও বেশি আসামির মধ্যে ৫ হাজার ৯২৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় সর্বোচ্চ সাত বছরের সাজা হয়েছে ৮৭০ জনের। আর বেকসুর খালাস পেয়েছেন ১১৫ জন বিডিআর সদস্য, যারা পরে চাকরি ফেরত পেয়েছেন।
ঢাকার জজ আদালত ২০১৩ সালে পিলখানার হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এছাড়া ২৫৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেয়।
ওই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির পর হাই কোর্ট ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে। এছাড়া ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২২৮ জনকে তিন থেকে দশ বছরের সাজা দেওয়া হয়।
নিয়মিত আদালতে একসঙ্গে এত আসামির ফাঁসির আদেশ যে কোনো মামলার ক্ষেত্রেই নজিরবিহীন।
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেও ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি তোলার খরচ, অনুলিপি পাওয়ার প্রক্রিয়া, আপিলের পেপারবুক তৈরি, আদালতে সেই পেপারবুক রাখার স্থান, চূড়ান্ত বিচারের সময়সহ বিচারিক প্রক্রিয়ার নানা কারণে আপিল শুনানি শুরু হতে দেরি হচ্ছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
ওই ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাই কোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও ১৩ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার বিচার।
বিস্ফোরক আইনের মামলায় এক হাজার ১ হাজার ৩৪৫ জন সাক্ষীর মধ্যে এই ১৩ বছরে নেওয়া হয়েছে মাত্র ২১০ জনের সাক্ষ্য। হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া এবং সাজা খাটা শেষ হওয়া ৪৬৮ আসামির মুক্তিও আটকে আছে এই বিস্ফোরক মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে।
বকশীবাজারে আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অস্থায়ী এজলাসে এ মামলার বিচারকাজ চলছে। আগামী ৯ ও ১০ মার্চ এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য আছে।
Leave a Reply